আর মাত্র দিন দশেকের মধ্যেই নির্ধারিত হবে, কে নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছেন বিশ্বের সবচেয়ে পরাক্রমশালী রাষ্ট্রকে। ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যিনি জয়লাভ করবেন, তিনি শুধু নিজের দেশের অর্থনীতিরই ভাগ্য নির্ধারণ করবেন না, একই সঙ্গে তার সিদ্ধান্তে আন্দোলিত হবে পুরো বিশ্বের অর্থনীতি। কারণ তার হাতেই থাকবে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক শক্তির নাটাই। তাই প্রায় শিয়রে এসে পড়া যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে বিশ্বের প্রায় সব প্রান্তের মানুষের আগ্রহ এখন তুঙ্গে।
এই হাইপ্রোফাইল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট দলীয় বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস এবং রিপাবলিকান মনোনীত সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পূর্বাভাস দিচ্ছে বিভিন্ন জনমত জরিপের ফলাফল। কেউ কারও থেকে পিছিয়ে না থাকায় নির্বাচনকে ঘিরে তাদের সমর্থকরা যেমন ভুগছেন স্নায়ুচাপে, তেমনি এই নির্বাচনকে ঘিরে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ী মহলে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সহযোগী বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক মহলও ভুগছে নানামুখী অনিশ্চয়তায়। বিশেষ করে তাদের সবার মনে ভয় ধরাচ্ছে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত ’রক্ষণশীল’ অর্থনৈতিক নীতি। পুনর্বার প্রেসিডেন্ট এর কুরসিতে বসতে পারলে আমেরিকাকে ফের ‘মহান’ রাষ্ট্রে পরিণত করার অঙ্গীকার করেছেন তিনি।
এজন্য অর্থনীতি ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ‘আমেরিকাই প্রথম’ এই নীতি গ্রহণের আগাম ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। এর অংশ হিসেবে গত কয়েক মাসে নির্বাচনী প্রচারণায় বহুবার যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী দেশগুলোর বিরুদ্ধে ‘বাণিজ্য’ যুদ্ধ শুরুরও হুমকি দিয়েছেন তিনি। বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী চীনই তার এসব হুমকি-ধমকির মূল নিশানা হলেও সত্যি সত্যিই ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হলে এর প্রতিক্রিয়া বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতেও অনুভূত হবে বলে সতর্ক করে দিচ্ছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষক সহ বিশ্ব বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহল।
৫ নভেম্বর নির্বাচিত হলে চীনের বিরুদ্ধে আরও বেশি আমদানি শুল্ক আরোপের মাধ্যমে নতুন করে ‘ট্যারিফ যুদ্ধ’ শুরুর হুমকি দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন উভয় দেশের সঙ্গেই ব্যবসা করে এ রকম তৃতীয় পক্ষের দেশগুলোকে চীনের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সতর্কতার সঙ্গে নীতি প্রণয়ন করতে হবে বলেও জানিয়েছে প্রভাবশালী থিংকট্যাংক ‘দি আরব গালফ স্টেটস ইনস্টিটিউট অব ওয়াশিংটন’। ইউরোপীয় থিংকট্যাংক ‘দি জার্মান ইকোনোমিক ইনস্টিটিউট’ এর মতে ট্রাম্প নির্বাচিত হলে নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রে সব ধরনের আমদানি হওয়া পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ আমদানি শুল্ক এবং চীন থেকে আমদানি হওয়া পণ্যের ওপর ৬০ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের এই রক্ষণশীল বৈদেশিক বাণিজ্য নীতি, ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেট’ হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের রাজ্যগুলোর ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে স্বভাবতই আকৃষ্ট করবে। এর বিপরীতে এই রাজ্যগুলোর কর্মজীবী ভোটারদের আকৃষ্ট করতে বৈদেশিক বাণিজ্য নীতিতে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিসের জন্যও খুব বেশি উদার হওয়ার সুযোগ নেই বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম পলিটিকো জানিয়েছে, নিজের নির্বাচনী প্রচারণায় এখনও নিজের বৈদেশিক বাণিজ্য নীতির ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে তেমন কিছু উল্লেখ করেননি কমলা হ্যারিস। কমলা হ্যারিসের এই নীরবতাই প্রমাণ করে যে, ভোটের লড়াইয়ে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাম্পের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির সমর্থন পেতে হলে তাকেও আপাতত ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতির ব্যাপারে চুপ থাকতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক নীতিতেও প্রভাব ফেলবে আগামী প্রেসিডেন্টের পদক্ষেপ। ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিস জানিয়েছেন, তিনি মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের ব্যাপারে বাইডেন সরকারের নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করবেন। বাইডেন সরকার বরাবরই সুদের হারের মতো গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক নীতির ব্যাপারে ফেডারেল রিজার্ভ কর্তৃপক্ষের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তবে প্রথম থেকেই ফেডারেল রিজার্ভের বিভিন্ন নীতির ব্যাপারে অসন্তোষ জানিয়ে আসছেন ট্রাম্প।
তিনি খোলামেলাই জানিয়েছেন, সুদের হার নির্ধারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে প্রেসিডেন্টের হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকা উচিত। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচিত হলে স্বভাবতই তিনি ফেডারেল রিজার্ভের সিদ্ধান্তে নাক গলাবেন বলে মনে হচ্ছে। যদি ট্রাম্প ফেডারেল রিজার্ভের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেন, বিশেষ করে সুদের হার নির্ধারণের ব্যাপারে, তবে এর প্রতিক্রিয়া পুরো বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থায় অনুভূত হতে পারে বলে জানিয়েছে ‘দি আরব গালফ স্টেটস ইনস্টিটিউট অব ওয়াশিংটন’।
এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘিরে এই দামামার মধ্যে শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে শুরু হয়েছে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলন। যেখানে সারা বিশ্ব থেকে সমবেত হয়েছেন বিশ্ব অর্থনীতির দিকপালরা। এবারের আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক সম্মেলনেও সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু হতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন।
এ ব্যাপারে রয়টার্সকে সাবেক আইএমএফ কর্মকর্তা ও মার্কিন থিংকট্যাংক আটলান্টিক কাউন্সিলের জিওইকোনোমিকস সেন্টারের প্রধান জশ লিপস্কি বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেই এই মুহূর্তে বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান ইস্যু। এটা শুধু আনুষ্ঠানিকতাই নয়, বরং সবাই এটার দিকেই তাকিয়ে।’
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে, চীন সহ বাণিজ্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে ট্যারিফ যুদ্ধ শুরু করা এবং জলবায়ু সংকট মোকাবিলার লড়াই থেকে সরে আসার যে ইঙ্গিত ডোনাল্ড ট্রাম্প দিয়েছেন, সেটাও এবারের আইএমএফ বিশ্বব্যাংক সম্মেলনের আলোচিত বিষয় হতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
এ ব্যাপারে রয়টার্সকে জন লিপস্কি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতি, ডলারের ভবিষ্যৎ এবং ফেডারেল রিজার্ভের পরবর্তী প্রধান কে হতে যাচ্ছেন, তার সব কিছুই নির্ভর করছে এই নির্বাচনের ওপর। সামগ্রিকভাবে এর সবকিছুরই প্রভাব পড়বে বাদবাকি বিশ্বের সব দেশের ওপর।’
কোভিড মহামারী ও পরবর্তীতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে না উঠতে উঠতেই যদি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’ শুরু হয়, তবে তা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত বলে মনে করা হচ্ছে। এই শঙ্কা প্রতিধ্বনিত হয় আইএমএফ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা এর কণ্ঠেও।
শুক্রবার আইএমএফ বিশ্বব্যাংকের সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তব্যে আইএমএফ প্রধান বলেন, ‘বিশ্ব আরও বিভক্ত হচ্ছে এবং পূর্বের মতো বাণিজ্য আর প্রবৃদ্ধির শক্তিশালী ইঞ্জিনের ভূমিকায় নেই, যা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করছে। জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগের নামে নতুন গজিয়ে ওঠা শিল্পনীতি, বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতা এবং রক্ষণশীল বাণিজ্য নীতির মাধ্যমে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সহযোগিতার বদলে পেছনের দিকে হাঁটার প্রবণতা শুরু হয়েছে।’
এদিকে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাণিজ্যিক অগ্রগতির পথে ট্রাম্পের ‘রক্ষণশীল বাণিজ্য নীতি’ বাধার সৃষ্টি করতে পারে বলে ইতোমধ্যেই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও এসব দেশের অর্থনীতির নীতি নির্ধারকরা। এ ব্যাপারে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক সম্মেলনে অংশ নেয়া নাইজেরিয়ার অর্থমন্ত্রী আদেবায়ো ওলাওয়ালে এদুন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা এই অতি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের নীরব দর্শক। এই নির্বাচনে বিশ্বায়ন ও বৈশ্বিক বাণিজ্যে উল্টোমুখী প্রবণতার আশঙ্কা রয়েছে, আশঙ্কা রয়েছে রক্ষণশীল বাণিজ্য নীতি গ্রহণের। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর সামনে বৈশ্বিক বাণিজ্যের সম্প্রসারণের মাধ্যমে বিনিয়োগ, প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র বিমোচনের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, এর সবকিছুই তার বিরুদ্ধে কাজ করবে।
এর আগে গত জুন মাসে লেখা এক চিঠিতে বিশ্বের ১৬ জন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ আশঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছিলেন, যদি ডোনাল্ড যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করেন, তবে যুক্তরাষ্ট্র সহ বাদবাকি পুরো বিশ্ব মূল্যস্ফীতির সম্মুখীন হবে।